ঢাকা, সোমবার ০৬, মে ২০২৪ ৯:৩৯:১৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বজ্রপাতে বসতঘরে আগুন, ঘুমের মধ্যে মা-ছেলের মৃত্যু এএফআইপি ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী আজ থেকে স্কুল কলেজ খোলা সুন্দরবনে আগুন নেভানোর কাজ শুরু জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন সিলেট ৬০ টাকার নিচে মিলছে না সবজি, মাছ-মাংসে আগুন আরও ২ দিন দাবদাহের পূর্বাভাস

মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে প্রাণ দেন কমলা 

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:১০ পিএম, ১৯ মে ২০২২ বৃহস্পতিবার

কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র নারী ভাষা শহীদ

কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র নারী ভাষা শহীদ

কমলা ভট্টাচার্য; মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন এই কিশোরী। ১৯৬১ সালের আজকের দিনের (১৯ মে) কথা। ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন চলছে। 

আন্দোলন চলকালে ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি তরুণ নিহত হন। ভাষার দাবিতে জীবন উৎসর্গ করা সেই ১১ বাঙালি বীর সন্তানের মাঝে একজন কিশোরী ছিলেন। কমলা ভট্টাচার্য নাম তার। ষোল বছর বয়সী এই কমলা বাংলা ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেন। কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র নারী ভাষা শহীদ।

কমলার জন্ম ১৯৪৫ সালে, আসামের সিলেটে (শ্রীহট্টে)। রামরমণ ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনে দিন কাটতে থাকে কমলার পরিবারের। 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্ট সিলেট (শ্রীহট্ট) জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা শুরু হলে তার রেশ সিলেটে (শ্রীহট্ট) এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে যেতে বাধ্য হন। তারা সিলেট পার্শ্ববর্তী আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে গিয়ে আশ্রয় নেন।

কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বা[ড়িতে। কমলার বড় বোন বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমূলগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজ বোন প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। মেজ বোনের সামান্য আয়েই চলতো কমলাদের পরিবার। 

শৈশবে কমলা ভর্তি করা হয় শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্‌ষ্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের বই কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার পরিবারের। কমলা একবার বড় বোনকে বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতক পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলে ঠিক করেন।

কমলার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবীতে একটি পিকেটিংয়ের ডাক দেয়া হয়। ১৯ মে সকালে কমলাও পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য তৈরি হন। সকালে গোসল শেষ করে মেজ বোনের জন্য রাখা শাড়িটা পড়ে নেন কমলা। মেজ বোন পিকেটিং-এ যেতে বারণ করলেও শোনেন নি তিনি। 

সকালে কমলাকে নেয়ার জন্য ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাদের বাড়িতে আসে। কমলার মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারা কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করেন। কমলার মা কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেড়িয়ে পড়ে তার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল এবং বড় বোনের ছেলে বাপ্পা। 

দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। জানা যায়, বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশে ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা। মায়ের পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। তারপর মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করতে শান্তনা দিয়ে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ। এর পরে গণ অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২.৩৫ নাগাদ বিনা প্ররোচণায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথারি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হঠাৎ এ ধরনের আক্রমণে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যান। তিনি সাহায্যের জন্য কমলাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন। এরই মধ্যে আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে। 

মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখনেই তার মৃত্যু হয়। 

মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস পরে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।

এই ঘটনার পর আসাম সরকার বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। কমলা ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। দেখা যায় মেধাবী ছাত্রী কমলা বেশ ভালোভাবেই পাশ করেছেন। পরীক্ষার পর কমলা টাইপ রাইটিং শিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়।

কমলা ভট্টাচার্যের স্মরণে শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের নাম করা হয় 'কমলা ভট্টাচার্য রোড'। এছাড়াও ২০১১ সালে আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তার স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠান ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি কমলা ভট্টাচার্যের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়।